যেভাবে বাংলাদেশে মাকে খুঁজে পেলেন নরওয়ের এলিজাবেথ

ঘটনা অনেকটা সিনেমার মতোই। জন্মের ৪৯ বছর পর নরওয়ে থেকে বাংলাদেশের মাদারীপুরে এসে মাকে খুঁজে পেলেন এলিজাবেথ ফিরোজা। দীর্ঘ এই দূরত্বে মা ও মেয়ের মধ্যে এসেছে অনেক পরিবর্তন। তবে মমতা কমেনি এতটুকুও। 

ফিরোজা বেগমের বিয়ে হয়েছিল ১৩ বছর বয়সে। তখন ১৯৭৫ সাল। এর কিছুদিন পর ফিরোজা যখন পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা, তখন মারা যায় তার স্বামী। নিজের বাবাকেও হারাতে হয় তখন।

বাবা আর স্বামী হারিয়ে অভাব আর দারিদ্র্যের চরম বাস্তবতার মুখে পড়েন ফিরোজা। এসবের মধ্যেই ১৯৭৫ সালের ১৫ জুলাই ফিরোজার কোলজুড়ে আসে এক কন্যাসন্তান। নামে রাখেন মৌসুমী। সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে দুঃখ-কষ্ট ভুলে থাকার চেষ্টা করেন ফিরোজা। কিন্তু পারেননি তিনি।

অভাবের তাড়না সইতে না পেরে একই বছরের ৩০ আগস্ট ঢাকার মোহাম্মদপুরে সমাজসেবা অধিদফতর পরিচালিত শিশুসদনে বিনা শর্তে নিজের সন্তানকে রেখে যান ফিরোজা বেগম। মৌসুমীর বয়স যখন চার মাস, তখন নরওয়ের এক নিঃসন্তান দম্পতি ঢাকায় এসে সমাজসেবা অধিদফতরের মাধ্যমে শিশুটিকে দত্তক নেন। পরে নতুন বাবা-মায়ের সঙ্গে মৌসুমী পাড়ি জমায় নরওয়েতে। মৌসুমির নাম দেওয়া হয় এলিজাবেথ রয়েড। ফিরোজা বেগমের শিশুসদনে রেখে যাওয়া সেই সন্তানের বয়স যখন ২২ বছর, তখন তিনি জানতে পারেন তাঁর মা বাংলাদেশি। তবে এ বিষয়ে আর কোনো তথ্য ছিল না তাঁর কাছে। মাকে খুঁজে পাওয়ার তৃষ্ণায় কেটে গেছে বহু বছর। অনেক খোঁজাখুঁজির পরে অবশেষে এলিজাবেথ ফিরোজা সমাজসেবা অধিদফতরের মাধ্যমেই জানতে পেরেছেন তাঁর গর্ভধারিণী মা ফিরোজা বেগমের সন্ধান।

৪৯ বছরের অপেক্ষা শেষ হলো গত বৃহস্পতিবার (২৮ মার্চ)। মা-মেয়ের দেখা হলো মাদারীপুরের শিবচর উপজেলার মাদবরেরচর ইউনিয়নের পোদ্দারচর এলাকার ফিরোজা বেগমের বাড়িতে। এ সময় মাকে কাছে পেয়ে এলিজাবেথ ফিরোজা জড়িয়ে ধরেছেন, কান্নায় আবেগে আপ্লুত হয়েছেন মা-মেয়ে। এলিজাবেথ বাংলা ভাষা না জানায় কেউ কারও মুখের ভাষা বুঝতে না পারলেও আবেগ-অনুভূতি দিয়েই ভাবের আদান-প্রদান করেন তাঁরা। মাকে কাছে পেয়ে বারবার মুখে মুখ মেলান আর দুজনের চেহারার মিল খুঁজছিলেন এলিজাবেথ।

বৃহস্পতিবার সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত মায়ের সঙ্গে কয়েক ঘণ্টা সময় কাটানোর পর বিকেলেই স্বামী হেনরিক ফাজালসেটের সঙ্গে ঢাকায় ফিরে যান এলিজাবেথ।

ফিরোজা বেগম বলেন, মায়ের জন্য নরওয়ে থেকে নতুন জামা-পায়জামা, কসমেটিকসসহ বিভিন্ন উপহার নিয়ে এসেছেন তাঁর মেয়ে এলিজাবেথ ফিরোজা ওরফে মৌসুমী। বাড়িতে এসে নিত্যপ্রয়োজনীয় সব বাজার করে দিয়েছেন মেয়ে ও জামাতা। আর নরওয়ে থেকে তাঁর মাকে যেন দেখতে পারেন, এ জন্য কিনে দিয়েছেন একটি স্মার্টফোন।

৫০ বছর পরে সেই ছোট্ট মৌসুমীকে এলিজাবেথ রূপে দেখতে পাবেন, এমনটা স্বপ্নেও ভাবেননি ষাটোর্ধ্ব ফিরোজা বেগম। গতকাল শনিবার সন্ধ্যায় তিনি বলেন, ‘আমার মাইয়াডা যে বাইচা আছে, এত বড় হইছে, তাই তো কোনো দিন চিন্তা করি নাই। আমার মাইয়াডা ফিরা আইছে, বুকে জড়াইয়া ধরতে পারছি, এইডা ভাবলেই আমার কলিজা ছিঁড়া যাচ্ছে। আমার বুকের ধনরে আল্লাহ তুমি ফিরাইয়া দিছ, তোমার কাছে লাখ লাখ শুকরিয়া।’

ফিরোজা বেগম শনিবার বিকেলে ঢাকায় গেছেন। রোববার দুপুরে তাঁর মেয়ে এলিজাবেথের সঙ্গে দেখা হবে। এলিজাবেথ তাঁকে শিগগিরই নরওয়েতে নিয়ে যাবেন বলে জানালেন।

শিবচরের মাদবরচর ইউনিয়নের পোদ্দারচর গ্রামের মৃত বছির সরদারের স্ত্রী ফিরোজা বেগম। স্বামী মারা যাওয়ার কয়েক বছর পরে তিনি দ্বিতীয় বিয়ে করেন। তবে সেই ঘরে কোনো সন্তান নেই ফিরোজা বেগমের। আগে ঢাকায় বসবাস করলেও এখন স্বামীসহ পোদ্দারচরে বসবাস করছেন।

মাদবরচর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ফজলুল হক বলেন, ‘মা আর মেয়ের একত্র হওয়াটা যেন এখনো চোখে ভাসছে। তাদের গল্পটা হৃদয় জুড়িয়ে দিয়েছে। ৪৯ বছর পর মেয়ে তাঁর মাকে ফিরে পেয়েছে। মেয়ে মায়ের টানে সেই সুদূর নরওয়ে থেকে আমাদের এলাকায় এসেছে। সত্যিই সবকিছু রূপকথার গল্পের মতো মনে হচ্ছে। তবে এটিই সত্যি।’

এলিজাবেথ ও তাঁর বন্ধু খ্রীষ্টফারের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নরওয়ের আরেন্ডাল শহরে স্বামী হেনরিক ফাজালসেট আর চার সন্তান নিয়ে বসবাস করেন এলিজাবেথ ফিরোজা ফাজালসেট। বাংলাদেশ থেকে ১৯৭৫ সালে নরওয়ের চিকিৎসক রয় রয়েড আর তাঁর স্ত্রী ক্যারেন রয়েড দম্পতি এলিজাবেথকে দত্তক হিসেবে নিয়ে যান। এলিজাবেথ পেশায় একজন স্বাস্থ্যকর্মী। বড় হওয়ার পর তিনি জানতে পারেন তাঁর প্রকৃত বাবা-মা বাংলাদেশি। তবে জানতেন না তাঁরা কারা। শুধু জানতেন মায়ের নাম ফিরোজা বেগম আর বাবা মৃত বশির সরদার। জন্ম হয়েছিল বাংলাদেশের ঢাকা শহরে। আর এই তথ্যও তিনি পেয়েছেন প্রথম পাসপোর্ট আর নরওয়ের দত্তক নেওয়া পরিবারের কাছে থাকা দলিলপত্র থেকে।

শুরু হয় মাকে খোঁজার নতুন যুদ্ধ। ২০১৩ সালে স্বামী–সন্তানদের নিয়ে এলিজাবেথ প্রথম আসেন বাংলাদেশে। সেবার মাকে খোঁজাখুঁজি করেও খালি হাতেই ফিরতে হয়েছিল তাঁকে। তবে এলিজাবেথ তাঁর বাংলাদেশি বন্ধু খ্রীষ্টফারকে নিজের মায়ের কথা বলে গিয়েছিলেন। এরপর গত ২৩ মার্চ স্বামীকে নিয়ে আবারও বাংলাদেশে মায়ের খোঁজে আসেন এলিজাবেথ। সহযোগিতা নেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পরিচালক মোস্তফা জামিল খানের। সেখান থেকে যান সমাজসেবা অধিদফতরের। সেখানকার কর্মকর্তা আবু নাঈম খুঁজে বের করেন দত্তক নেওয়ার সেই ৪৯ বছর আগের পুরোনো নথি। তাতে পাওয়া যায় এলিজাবেথের মায়ের গ্রামের ঠিকানা।

এলিজাবেথের বন্ধু খ্রীষ্টফার বলেন, ‘বিদেশে একটি প্রতিষ্ঠানে কাজ করার সুবাদে এলিজাবেথের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। এলিজাবেথ আমার খুব ভালো বন্ধু। আমি বাংলাদেশি হওয়ায় এলিজাবেথ আমাকে সবকিছু খুলে বলে। কিন্তু আমরা প্রথম চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পরে আশা ছেড়ে দিয়েছিলাম। কখনো ভাবিনি এলিজাবেথ তাঁর মাকে খুঁজে পাবে। সবই সৃষ্টিকর্তার অসীম কৃপা। মা ও মেয়ের মিলন ঘটাতে পেরে আমি খুবই আনন্দিত।’

এলিজাবেথ ফিরোজা বলেন, নরওয়ের বাবা-মা তাঁর নাম রাখেন এলিজাবেথ। বড় হয়ে জানতে পারেন তাঁর জন্ম বাংলাদেশে, মায়ের নাম ফিরোজা বেগম। এর পর থেকে তিনি ফিরোজা নামটিকে নিজের নামের সঙ্গে যুক্ত করেন। বিয়ের পরে নরওয়ের এক চিকিৎসক তাঁর জীবনকাহিনি জানতে চান। তখন থেকেই নিজের পরিবারকে খোঁজার চেষ্টা শুরু করেন। এ বিষয়ে তাঁর স্বামী হ্যানরি ও সন্তানেরা তাঁকে সাহায্য করেছে। নরওয়েতে তাঁর তিন ছেলে ও এক মেয়ে এবং নাতি-নাতনি আছে বলে জানান তিনি।

এলিজাবেথ ফিরোজা আরও বলেন, ‘গত দুই বছর এক মুহূর্তের জন্যও জন্মভূমি আর মায়ের কথা ভুলতে পারিনি। নিজের মাকে কাছে পেয়ে নিজেকে পূর্ণাঙ্গ মনে হচ্ছে। তবে দত্তক দেওয়ার জন্য মাকে আমি কখনোই দায়ী করিনি। মায়ের সেই সময়ের অসহায়ত্বকে আমি বুঝতে পারছি। নরওয়েতে একটি ভালো পরিবারের কাছে বড় হয়েছি। নরওয়ের বাবা-মায়ের প্রতিও আমার অসীম ভালোবাসা। বাংলাদেশের মানুষের ভালোবাসা ও সহযোগিতা পেয়েছি। সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *