খালিদ আনোয়ার সাইফুল্লাহ। নামটির সঙ্গে সম্ভবত খুব বেশি মানুষ পরিচিত নন। চাইমের খালিদ—এই নামটি ৮০ বা ৯০ দশকের সংগীতপ্রেমীদের কাছে পরিচিত। বাংলাদেশের ব্যান্ড গানের সুবর্ণ সময় ছিল আশির দশক থেকে শূন্য দশক। তখনই খালিদের উত্থান।
আশির দশকে এ দেশে রক শুরু হলেও সেটা ভাইব্রেট করে ৯০ এর দশকে। সেই সময়ের জনপ্রিয় ব্যান্ড ছিলো সোলস, মাইলস্, এলআরবি, ফিডব্যাক, রেনেসাঁ, চাইম, ডিফরেন্টটাচ, নোভা, অবসকিওর, উইনিং, প্রমিথিউস, ওয়ারফেজসহ আরো বেশ কিছু ব্যান্ড দল।
তবে মজার ব্যাপার হলো এই সকল ব্যান্ড দলগুলোই দারুণ জনপ্রিয় ছিল শ্রোতাদের কাছে। সারাদেশে নিয়মিত ভাবেই ওপেন এয়ার ব্যান্ড শো হতো। ৯০ দশকের সেই উন্মাদনা এখন একেবারেই নেই। তখন সবাই দারুণ পারফরম্যান্স করতো। কনসার্ট হওয়ার এক সপ্তাহ ১০ দিন আগে থেকেই শহরে একটা আলোচনা শুরু হতো। মহল্লায় মহল্লায় হৈ-হৈ অবস্থা।
ব্যান্ডগুলো নিয়মিতভাবেই ঢাকডোল পিটিয়ে অ্যালবাম প্রকাশ করত। শ্রোতারাও অপেক্ষায় থাকতেন। ক্যাসটের দোকানের সামনে ঝুলত রকস্টারদের পোস্টার। দোকানে ঢুঁ মেরে প্রিয় শিল্পীর নতুন অ্যালবাম এসেছে কি না তা অনেকেই খোঁজ নিতেন।
তখনকার নতুন অ্যালবামের পোস্টারের ডিজাইন ছিলো চোখে পড়ার মতো। ক্যাসেটের দোকানগুলোতে প্রায় সারাদিনই হাই-ভলিউমে গান বাজতো।
চাইম ও আর্কের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা আশিকুজ্জামান টুলু সম্ভবত প্রথম ‘স্টার’ নামে মিক্সড অ্যালবাম বাজারে এনে হৈ-চৈ ফেলে দেয়। অল্প সময়ের মধ্যে মার্কেট আউট হয়ে যায় এই ক্যাসেট। এরপরে টুলু আর প্রিন্স মাহমুদ একের পর এক হিট মিক্সড অ্যালবাম বাজারে আনেন। গানের নতুন এক আমেজ আসে এক মোড়কে ১২ জন শিল্পীর গানে।
চাইম ব্যান্ডের ঘরে অনেক ভাঙন আসে। আসা-যাওয়া চলতে থাকে। কিন্তু খালিদ নিজেকে ঠিকই মেলে ধরেন।
সম্ভবত ৮৬/৮৭ সালে বিটিভির একটি অনুষ্ঠানে ‘জয় জগানন্দন ঘটিবাটি বন্ধন…’ গান দিয়ে আলোচনায় আসেন খালিদ। এরপর তার গানের সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। এরপরে ‘কীর্তনখোলা নদী’, ‘সেদিন আকাশে ছিলো চাঁদ’ গান দিয়ে জয় করে নেন লাখো শ্রোতাদের হৃদয়।
৯৫ সালের পরের দিকে মাইলস্, এলআরবি, ফিডব্যাক সেরা ব্যান্ড হলেও সোলোতে খালিদ, উইনিংয়ের চন্দন, পার্থ বড়ুয়া ছিলেন সাংঘাতিক জনপ্রিয়। পরবর্তীতে প্রতিটি মিক্সড অ্যালবাম যেনো অপরিহার্য হয়ে যায়।
একবিংশ শতাব্দির শুরুর থেকেই তরুণদের ঠোঁটে ঠোঁটে শুধু খালিদের গান। এর মধ্যে ‘সরলতার প্রতিমা’, ‘আকাশ নীলা তুমি’ ‘যতটা মেঘ হলে বৃষ্টি নামে’, ‘কোনো কারণেই ফেরানো গেল না তাকে’, ‘হয়নি যাবারও বেলা’, ‘যদি হিমালয় হয়ে দুঃখ আসে’, গানগুলো খালিদকে হিমালয়সম উচ্চতায় নিয়ে যায়।
অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে এতো চমৎকার সফট মেলোডি করে জনপ্রিয়তার শীর্ষ চুড়ায় থেকেও খালিদ যেন ছিলেন অনেকটা নিভৃতচারী। পুরো ৯০ দশক যেমন সারা দেশে ওপেন এয়ার কনসার্ট করতেন পরবর্তীতে পাওয়া যায়নি গ্রুপ প্রোগ্রাম করতে। তবে ব্যান্ড চাইম অনেক বছর ব্যবধানে ‘নারী’ নামে একটা অ্যালবাম প্রকাশ কর। অ্যালবামটি হিট না করলেও ‘দাও আলো দাও চাঁদ’, ‘দেখেছি তোমায়’ গানগুলো জনপ্রিয়তা পায়।
খালিদ সাইফুল্লাহ তার জীবনের শেষ দিকে গানের থেকে দূরে থাকলেও তার গান ছিল এই প্রজন্মের তরুণদের মুখে মুখে। এই মহান কন্ঠ শিল্পীর চলে যাওয়ায় কেদেছে লক্ষ লক্ষ সংগীতপ্রেমী। আমরা তার রুহের মাগফেরাত কামনা করি।