অ্যাড. মোঃ রাশেদুল হক, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট :
অনলাইন বা ভার্চুয়াল জগৎ আমাদের দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে যেমন জড়িয়ে আছে, ঠিক তেমনি জড়িয়ে আছে পরিবারের শিশু-কিশোরদের জীবনেও। করোনাকালে এখন অনলাইনে শুরু হয়েছে স্কুল-কলেজ-ভার্সিটির ক্লাস।এমনকি শিশুদের জন্যও শুরু হয়েছে অনলাইন ক্লাস, যা প্রশংসনীয় উদ্যোগ। শিশুদের জীবনেও ক্রমে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে ভার্চুয়াল জগত।
২০১৯ সালে UNICEF ১০-১৭ বছর বয়সী স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের নিয়ে “বাংলাদেশে শিশুদের অনলাইন নিরাপত্তা ” বিষয়ক এক জরিপ পরিচালনা করে। জরিপে উঠে আসে অংশগ্রহণকারী ১২৮১ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে প্রায় ২৫% শিক্ষার্থী ১১ বছর বয়স হওয়ার আগেই ইন্টারনেট ব্যবহার শুরু করেছে। এই জরিপে আরো উঠে এসেছে যে, ৬৩% ছেলে এবং ৪৮ % মেয়ে শিশু প্রতিদিন অনলাইন ব্যবহার করেন। কিন্তু উদ্বেগের কথা এদের মধ্যে ৩২% শিশু- কিশোর বিভিন্ন সময় সাইবার বুলিং এর শিকার হয়েছে!
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সহ সন্তানের ইন্টারনেট আসক্তি অভিভাবকদের দুশ্চিন্তার মূল কারণ । অনলাইনে শিক্ষার্থীদের জন্য শিক্ষনীয় ও প্রয়োজনীয় কন্টেন্ট যেমন রয়েছে তেমনি রয়েছে কিছু ক্ষতিকর দিক যা নৈতিক অবক্ষয়ের ফাঁদ। UNICEF এর জরিপে অংশগ্রহণকারী অধিকাংশ শিশু-কিশোর বলেছেন, তারা সাধারণত ইন্টারনেট ব্যবহার করেন তাদের বেড রুমেই। জরিপে অংশগ্রহণকারী ৭০ % ছেলে এবং ৪৪% মেয়ের ফেসবুকে ফ্রেন্ড লিস্টে অপরিচিত বন্ধুর সংখ্যাই বেশি ! এদের ৩৩% প্রতি দিন চ্যাটিং করে এবং ৩০% প্রতিদিন অনলাইনে ভিডিও দেখে! এমনকি ১০% শিশু ধর্মীয় উগ্রবাদের কন্টেন্ট দেখেছে।
UNCEF এর জরিপে আরো উঠে আসে বুলিং এর শিকার হওয়া শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন মানসিক বৈকল্যে ভোগে। এ ধরনের শিক্ষার্থী স্কুল পালায়,নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে , পড়াশোনায় অমনোযোগী, ভগ্ন স্ব্যাস্থ্যের অধিকারী হয়। এমনকি মানসিক অবসাদ তাদের আত্মহত্যা পর্যন্ত করতে বাধ্য করেঅনলাইনে শিশু-কিশোরদের অবাধ পদচারনায় স্বাভাবিক ভাবেই অভিভাবকরা দুশ্চিন্তাগ্রস্থ। সন্তানের নিরাপদ সাইবার জগৎ নিশ্চিত করাই এখন বড় চ্যালেঞ্জ।
এছাড়াও পর্ণগ্রাফি,বুলিং,উগ্রবাদ, সাইবার ক্রাইম ডিজিটাল মাধ্যমে এখন নিয়মিত চিত্র! তাই নিজেকে সুরক্ষিত রাখতে শিশু- কিশোরদের সচেতনতা ও প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ খুবই জরুরী। সরকার ইতিমধ্যে শিশু- কিশোরদের জন্য ক্ষতিকর ওয়েবসাইট গুলো ফিল্টারিংয়ের কাজ শুরু করেছেন, ফেসবুকের মতো সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছেন। এতে করে শিশু-কিশোররা পর্ণগ্রাফি, উগ্রবাদের মতো ক্ষতিকর ওয়েব সাইট ও হ্যাকিং থেকে সুরক্ষিত থাকবে।”শিশু – কিশোরদের নিরাপদ সাইবার স্পেস” নিশ্চিত করতে আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) এর সুপারিশে বলা হয় এক্ষেত্রে ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডারদের ভূমিকা অপরিসীম। তাই ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার (ISP) দের জন্য সংশোধিত নীতিমালা এখন খুবই জরুরী।
তাই আপনার সন্তানের কম্পিউটার বা অন্যান্য ডিভাইস ঘরের এমন জায়গায় রাখুন যাতে করে আপনি সহজেই দেখতে পারেন আপনার সন্তানটি কি করছে, ডিভাইসে প্যারেন্টস কন্ট্রোলিং টুলস ব্যবহার করুন ও নিয়মিত ডিভাইসটি চেক করুন । ।
# শিশু-কিশোরদের সাইবার নিরাপত্তায় করণীয় –
★ অনলাইনের ভালো ও ক্ষতিকর বিষয়গুলো নিয়ে খোলামেলা আলোচনা করুন। নিয়মিত আপনার সন্তানের ব্রাউজিং হিস্ট্রি চেক করুন।
★ যে কোন লিংক বা অ্যাডে ক্লিক করা থেকে বিরত থাকতে উৎসাহিত করুন। ভাইরাস বা ম্যালওয়ারের ব্যাপারে সতর্ক করুন।
★শিশুদের জন্য ক্ষতিকর এমন ওয়েবসাইটগুলো ব্লক করে দিতে পারেন। মোবাইলে গুগোল অ্যাকাউন্ট ভিজিট করে আপনার বাচ্চার এক্টিভিটিস দেখতে পারবেন।
★ বাচ্চাদের সঙ্গে বন্ধু সুলভ আচরণ করুন, অনলাইনে কার সঙ্গে কথা বলছে,কি দেখছে বা কাদের সঙ্গে তথ্য শেয়ার করছে সেই দিকে নজর রাখুন।
★ আপনি অভিভাবক নিজের লোকেশন বা সন্তানের লোকেশন শেয়ার করা থেকে বিরত থাকুন। সন্তানের ছবি ও পার্সোনাল ডেটা অনলাইনে শেয়ার করা থেকে বিরত থাকুন।
★ আপনার শিশুর ব্যবহারের পরিবর্তনের দিকে খেয়াল রাখুন।আপনার সন্তান আপনাকে কী বলতে চায় ধৈর্য্য ধরে শুনুন।
★ আপনার হোম ওয়্যারলেস নেটওয়ার্ক সিকিউর রাখুন।
সন্তানের ডিভাইসটি ওপেন নেটওয়ার্ক বা ফ্রি ওয়াই-ফাইতে কানেক্ট করাবেন না বা করতে দিবেন না।
শিশু-কিশোরদের সাইবার স্পেসে নিরাপদ রাখতে পিতামাতার সাথে সন্তানের বন্ধুসুলভ সম্পর্ক খুবই জরুরী।
ডিজিটাল মাধ্যমে নিরাপত্তা,ক্ষতিকর ও ভয়ঙ্কর দিকগুলো সম্পর্কে সন্তানকে সতর্ক করতে হবে। পাশাপাশি সরকারি – বেসরকারি সচেতনতামূলক উদ্যোগ জরুরী। আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মকে সাইবার জগতে সুরক্ষিত রাখতে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ, শিক্ষা ও সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। কোন ধরনের সাইবার ক্রাইম, বুলিং বা ব্ল্যাকমেইল এর শিকার হলে সঙ্গে সঙ্গে নিকটস্থ থানায় অভিযোগ করুন।সাইবার ক্রাইম ইউনিটে অভিযোগ করতে পারেন। আইনজীবীর মাধ্যমে সাইবার ট্রাইব্যুনালে মামলা করতে পারেন। স্বাভাবিক জীবনে আপনার সন্তানের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যেমন জরুরি, তেমনি ভার্চুয়াল জগতেও শিশু- কিশোরদের নিরাপত্তার গুরুত্ব অপরিসীম।
Leave a Reply