হাতে ধরা একখানা কাগজ। প্রথমে মনে হয় টাকার নোট কিংবা জমির দলিল। আরেকটু খেয়াল করলে দেখা যায়—ওটা আসলে নির্বাচনী লিফলেট। কারও কাছে ডাকটিকিটের মতো ছোট্ট কাগজ, কারও কাছে পুলিশের পোশাকে বানানো ভিডিও বার্তা।
আসন্ন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ-রাকসু নির্বাচন ঘিরে প্রার্থীদের এমন অভিনব প্রচারণা এবার শিক্ষার্থীদের ব্যাপক আকৃষ্ট করছে।
প্রচলিত মাইকিং, ব্যানার বা পোস্টারের বাইরে গিয়ে প্রার্থীরা এবার বেছে নিয়েছেন নতুন এই কৌশল। বুধবার (১৭ সেপ্টেম্বর) সকাল থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হল ও ক্যাম্পাসের বিভিন্ন প্রান্তে দেখা যায় অভিনব এই প্রচারণা।
সরেজমিনে দেখা গেছে, প্রচারণার শুরুর দিন থেকেই সকাল-বিকেল হলগুলোতে হাতে হাতে লিফলেট পৌঁছে দিচ্ছে প্রার্থীরা। শুধু লিফলেট নয়, নিজেদের যোগ্য প্রমাণ করতে দিচ্ছেন ভিডিও বার্তাও। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও ছড়ানো হচ্ছে নানা পোস্টার ও ভিডিও। ফলে ক্যাম্পাসে তৈরি হয়েছে অন্যরকম নির্বাচনমুখর পরিবেশ।
ইতিহাস বিভাগের শিক্ষার্থী নাজমুল বলেন, ‘এইবারের নির্বাচনে প্রচারণা সত্যিই আলাদা ও আকর্ষণীয়। শুধু লিফলেট নয়, ভিডিও বার্তা ও সরাসরি কার্যক্রমের মাধ্যমে প্রার্থীরা আমাদের কাছে পৌঁছে যাচ্ছেন। টাকার বা দলিলের মতো লিফলেট দেখেও আমরা বুঝতে পারছি তাদের সৃজনশীলতা ও মনোযোগ। এতে শিক্ষার্থীদের আগ্রহ বেড়েছে। পুরো ক্যাম্পাস এখন উৎসবমুখর।’
সহকারী পরিবেশ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক পদপ্রার্থী শরিফুল ইসলাম টাকার আদলে ছাপিয়েছেন লিফলেট। লিফলেটে তার কর্মসূচি ও পরিবেশবান্ধব পরিকল্পনার বিস্তারিত লেখা রয়েছে।
তিনি বলেন, ‘আমাদের প্রচারণায় শিক্ষার্থীরা যেন সহজে বার্তা মনে রাখতে পারে, সেই চিন্তা থেকেই টাকার নকশা ব্যবহার করেছি। চোখে পড়বে, মনে থাকবে—এইটাই উদ্দেশ্য। তবে শুধু আকর্ষণ নয়, আমাদের কর্মসূচি নিয়েও শিক্ষার্থীরা ভাবুক, সেটিই মুখ্য।’
সংস্কৃতিবিষয়ক সম্পাদক পদপ্রার্থী জায়িদ হাসান জোহা ভিডিও বানিয়েছেন পুলিশের পোশাক পরে। ভিডিওতে তিনি ৫ নম্বর ব্যালটে ভোট চান। তিনি ব্যাখ্যা করলেন, ‘ভিডিওতে পুলিশের পোশাক ব্যবহার করা হয়েছে শিক্ষার্থীদের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য। আমরা চাই, সবাই বুঝুক ভোট দেওয়া কত গুরুত্বপূর্ণ। আমি নির্বাচিত হলে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড ও শিক্ষামূলক আয়োজনকে নতুনভাবে শক্তিশালী করব।’
মিডিয়া ও প্রকাশনা সম্পাদক পদে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে ভোটের লড়াইয়ে মাঠে নেমেছেন মো. ফাহির আমিন। তিনি জমির দলিল, হলফনামা এবং ডাকটিকিটের আদলে প্রচারপত্র বানিয়েছেন। এগুলো দেখতে শিক্ষার্থীদের প্রথমে মনে হয় আইনি কাগজপত্র বা ডাকের সামগ্রী।
পরে বোঝা যায়—এসব তার নির্বাচনী প্রচারণা। ফেসবুকেও তিনি এসব ছবি ও ভিডিও শেয়ার করছেন। তিনি বলেন, ‘রাকসু নির্বাচনকে প্রাণবন্ত করতেই আমার এ উদ্যোগ। প্রচারে ভিন্ন কিছু থাকলে তা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। প্রচারেই প্রসার—এই বিশ্বাস থেকেই এ ব্যতিক্রমী আয়োজন।’
ছাত্রদল প্যানেল থেকে এজিএস পদে ভোট করছেন জাহিন বিশ্বাস এশা। তার ব্যালট নম্বর ৫। তিনি কৌশল অবলম্বন করেছেন ভিন্ন ধাচের। কাগজ দিয়ে হাতের পাঁচটি আঙ্গুল অঙ্কন করেছেন। পাঁচ আঙ্গুলে তিনি পাঁচ ধরনের প্রতিশ্রুতি নিয়ে যাচ্ছেন ভোটারদের দ্বারে দ্বারে। ছাত্রদল সমর্থিত এই প্রার্থী বলেন, ‘অনেকেই অনেকভাবে প্রচারণা চালাচ্ছে। আমার ব্যালট নম্বর ৫। ভোটারদের মনোজগতে সেটি ঢুকিয়ে দিতেই আমাদের এই কৌশল।
শিক্ষার্থীদের ভিশনকে প্রাধান্য
ভিপি পদে ইসলামী ছাত্রশিবির মনোনীত মোস্তাকুর রহমান জাহিদ বলেন, ‘রাকসু নির্বাচন শিক্ষার্থীদের দীর্ঘদিনের প্রাপ্য অধিকার। আমরা চাই ক্যাম্পাসে একটি গণতান্ত্রিক, সুষ্ঠু ও জবাবদিহিমূলক পরিবেশ প্রতিষ্ঠা হোক। এজন্য প্রতিটি হলে আমরা শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সরাসরি কথা বলছি। তাদের অভিজ্ঞতা ও প্রত্যাশা মনোযোগ দিয়ে শুনছি। একই সঙ্গে লিফলেট, ভিডিও বার্তা ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের মাধ্যমে আমাদের ভিশন ছড়িয়ে দিচ্ছি।’
অন্যদিকে ছাত্রদল মনোনীত ভিপি প্রার্থী শেখ নূর উদ্দিন আবীর বলেন, ‘রাকসু নির্বাচনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা হারানো প্রাণচাঞ্চল্য ফিরে পাচ্ছে। ছোটবেলায় ঈদের আনন্দ যেমন আমাদের মনে ভর করতো, এখন রাকসু নির্বাচন ঘিরেও সেই উৎসবমুখর পরিবেশ তৈরি হয়েছে। আমরা চেষ্টা করছি শিক্ষার্থীদের কাছে ঘনিষ্ঠভাবে পৌঁছাতে এবং তাদের প্রত্যাশাকে গুরুত্ব দিতে।’
প্রধান নির্বাচন কমিশনার এফ নজরুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা লক্ষ্য করেছি, প্রার্থীরা এবার সৃজনশীল কৌশল নিয়েছেন। শিক্ষার্থীরা আগ্রহী হচ্ছেন। তবে ভোট যেন নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ হয়, সেই দায়িত্ব আমাদের। ক্যাম্পাসে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় কঠোর নজরদারি থাকবে।’
তিনি আরও জানান, নির্বাচনের দিন সার্বিক নিরাপত্তার জন্য দুই হাজার পুলিশ মোতায়েন থাকবে। ভোটগণনার পুরো প্রক্রিয়া সরাসরি সম্প্রচার করা হবে।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে এখন উৎসবের হাওয়া। কারও হাতে দলিলসদৃশ কাগজ, কারও টেবিলে ডাকটিকিটের মতো লিফলেট। ফেসবুকে চোখ রাখলেই ভেসে উঠছে প্রার্থীদের ভিডিও।
শিক্ষার্থীরা বলছেন, এবারকার নির্বাচনী প্রচারণা শুধু রঙিন পোস্টার নয়, সৃজনশীলতাও বহন করছে। আর সেই ভিন্নতা ভোটারদের আগ্রহ বাড়িয়েছে অনেকগুণ।