• প্রতিদিন বিক্রি অর্ধকোটি টাকার টিকিট
• লাইভ সম্প্রচারে লটারির ড্র
• সব জেনেও নীরব প্রশাসন
কুমিল্লায় কুটির শিল্প ও বাণিজ্য মেলায় লটারির নামে চলছে রমরমা জুয়া। প্রতিদিন র্যাফল ড্র’র নামে ২০ টাকা মূল্যের টিকিট বিক্রি চলছে কুমিল্লার সর্বত্র। মেলা শুরুর প্রথমদিকে মাইকিং করে মহানগরসহ বিভিন্ন উপজেলায় টিকিট বিক্রি করলেও এখন নগরীর অলি-গলি, স্কুল-কলেজের সামনে, গ্রামের পাড়া-মহল্লা ও হাট-বাজারে চলছে বিক্রি। অবৈধভাবে প্রতিদিন প্রায় অর্ধকোটি টাকার টিকিট বিক্রি হচ্ছে। মোটরসাইকেল, টিভি, ফ্রিজ, ল্যাপটপ, সোনাসহ ছোট-বড় বহু পুরস্কারের চটকদার বিজ্ঞাপনে ক্রেতাদের মনোযোগ আকর্ষণ করা হচ্ছে।
প্রকাশ্যে ফেসবুক, ইউটিউবসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সরাসরি সম্প্রচার করে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করা হলেও অজ্ঞাত কারণে প্রশাসন নীরব। এ বিষয়ে কেউ কিছুই বলছে না।
এদিকে পুরস্কারের লোভে ও নেশায় সর্বস্বান্ত হচ্ছে নিম্ন আয়ের মানুষ। এই নেশা ধরেছে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে উঠতি বয়সের তরুণ-তরুণীদেরও। ঘড়ির কাটা রাত সাড়ে ১০টায় এলেই সব কাজ ফেলে মোবাইল সেটের সামনে বসে পড়েন শিক্ষার্থীসহ নিম্ন আয়ের খেটে খাওয়া মানুষ। একেকজন এক থেকে দেড়শ টিকিটও ক্রয় করছেন। কেউ কেউ মেলার শুরু থেকে এখন পর্যন্ত টিকিট ক্রয় করেই যাচ্ছেন। কিন্তু এর বদৌলতে ভাগ্যে জোটেনি একটি পুরস্কারও।
গত ২৪ এপ্রিল আনুষ্ঠানিকভাবে জাঙ্গালীয়া বাস স্ট্যান্ড এলাকায় মেলার উদ্বোধন হয়। চলবে আগামী ১৪ জুন পর্যন্ত। দৈনিক ১২০০-১৫০০ টাকা হাজিরায় সিটি করপোরেশনসহ জেলাজুড়ে প্রায় ২৫০ জন কর্মীর মাধ্যমে লটারির টিকিট বিক্রি করা হচ্ছে। প্রত্যেক কর্মী ৮০০ থেকে ১ হাজার টিকিট বিক্রি করছেন বলে সূত্র জানিয়েছে। সে হিসাবে একদিনে টিকিট বিক্রি হচ্ছে ৪৫ থেকে ৫০ লাখ টাকার।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে টিকিট বিক্রেতাদের একজন বলেন, মেলার শুরু থেকে বিভিন্ন স্থানে ২৫০-৩০০ কর্মী লটারির টিকিট বিক্রি করে আসছেন। বিনিময়ে আমাদেরকে ১২০০-১৫০০ টাকা হাজিরা দেওয়া হয়। টার্গেটের বেশি বিক্রি করতে পারলে বোনাসও দেওয়া হয়। প্রতিজন গড়ে ৮০০ থেকে ১ হাজার টিকিট বিক্রি করি। সে হিসাবে একদিনে টিকিট বিক্রি হচ্ছে ৪৫ থেকে ৫০ লাখ টাকার।
আশরাফুল আলম নামে এক রিকশাচালক বলেন, প্রতিদিন ৩০ পিস করে টিকিট নিচ্ছি। টানা ২৫ দিনে একটা সুতাও পাইনি। মোটরসাইকেল ও স্বর্ণের লোভও ছাড়তে পারছি না। যতদিন খেলা চলবে ততোদিন টিকিট কিনবো। দেখি আল্লাহ কপালে কী রেখেছে।
কুমিল্লা কমার্স কলেজের অধ্যক্ষ মো. হুমায়ূন কবীর মাসউদ বলেন, লটারির নামে শহর-গ্রামের অলিতে-গলিতে র্যাফল ড্র’র টিকিট বিক্রি করছে। চটকদার বিজ্ঞাপন দিয়ে সারাদিন রিকশা, ভ্যান চালিয়ে নিম্ন আয়ের খেটে খাওয়া মানুষের সর্বশেষ সম্বলটিও লুটে নিয়ে যাচ্ছে। সন্ধ্যার পর আনন্দ ফুর্তির নামে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরাও জড়িয়ে পড়ছে আড্ডা ও নানান অপকর্মের সঙ্গে। প্রশাসনের প্রতি অনুরোধ থাকবে এখনই এর লাগাম টানুন।
কুমিল্লা প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি মাসুক আলতাফ চৌধুরী বলেন, বাণিজ্য মেলায় লটারির নামে জুয়া চলছে। এমন কাণ্ড আগেও ঘটেছে। তখনও গণমাধ্যম সোচ্চার হলে কর্তৃপক্ষ এমন অনৈতিক আয়োজন বন্ধ করে মেলা চালায়। এবার আবার প্রকাশ্যে লাইভ করে প্রতিরাতে জুয়ার লটারির ড্র অনুষ্ঠিত হচ্ছে। রিকশাচালক থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ হুমড়ি খেয়ে লটারির টিকিট কিনে জুয়ায় জড়াচ্ছে। প্রশাসনের সামনে এমন আয়োজন চললেও কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না। ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন।
কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা বিএনপির সদস্য সচিব আশিকুর রহমান মাহমুদ ওয়াসিম বলেন, বর্তমান প্রশাসন কোন কাজটা সঠিকভাবে করছে? তাদের সামনেই অবাধে গোমতীর মাটি বিক্রিসহ অবৈধ সবকিছু চলছে। অকার্যকর প্রশাসনিক সমস্যা উত্তরণের জন্য আমরা বাংলাদেশে নির্বাচন চাই। এই ক্ষেত্রে শুধু মেলার কথা বললে লাভ হবে না, সবকিছুর কথা বলতে হবে। ডিসি, এসপি কেউ কারো কথা শুনছেন না। তাদের ইচ্ছামতো সবকিছু করছেন, দেশ চালাচ্ছেন। শুধু বাণিজ্য মেলার জুয়া না, আমরা সব কিছুর অবসান চাই।
কুমিল্লা মহানগরের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সদস্যসচিব মুহাম্মদ রাশেদুল হাসান বলেন, মেলার বাইরে টিকিট বিক্রি করা দুঃখজনক। আমি নিজেও একাধিকবার ২২নং ওয়ার্ডের কচুয়া চৌমুহানী, দৈয়ারা, লক্ষ্মীপুর ও দুর্গপুর এলাকায় বেশ কয়েকজন বিক্রেতাকে বিতাড়িত করেছি। আমাদের কাছে তথ্য রয়েছে নিম্ন আয়ের মানুষ তাদের ৬০-৭০ শতাংশ আয় দিয়ে প্রতিদিন র্যাফল ড্র’র কুপন কিনছে। এতে তিনি একদিকে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন, অপরদিকে পরিবারের ভরণপোষণ যোগাতেও হিমশিম খাচ্ছেন।
মেলার বাইরে টিকিট বিক্রির বিষয়ে জানতে র্যাফল ড্র’র দায়িত্বে থাকা মাহাবুবকে একাধিকবার ফোন করা হলেও রিসিভ না করায় তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
কুমিল্লা পুলিশ সুপার (এসপি) মোহাম্মাদ নাজির আহমেদ খাঁন বলেন, মেলার বাইরে লটারির নামে যদি টিকিট বিক্রি হয়, অবশ্যই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ আছে। বিষয়টি আমার জানা নেই, আপনার মাধ্যমে শুনছি। খোঁজ-খবর নিচ্ছি, সত্যি হলে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
জেলা প্রশাসক মো. আমিরুল কায়ছার বলেন, প্রথমত মেলার অনুমতি আমাদের থেকে নেওয়া হয়নি। এছাড়া র্যাফল ড্র’র নামে কুমিল্লার বিভিন্ন স্থানে যে টিকিট বিক্রি হচ্ছে এ সম্পর্কে আমি অবগত রয়েছি। তবে এটা অনাকাঙ্ক্ষিত, অন্যায্য এবং অন্যায়। কোনো ভুক্তভোগী যদি লিখিত অভিযোগ দেন, প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
এ বিষয়ে মেলার দায়িত্বে থাকা বিল্লাল হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, সেনাবাহিনী থেকে অনুমোদন নিয়ে জাঙ্গালিয়া ডিওএসএইচ মাঠে মেলার আয়োজন করা হয়েছে। মেলাকে আকর্ষণীয় করতে এবং বেশি দর্শনার্থী আনতে প্রবেশ টিকিটের ওপর র্যাফেল ড্র’র ব্যবস্থা করেছি। মেলাটি যেহেতু রাস্তার পাশে তাই এখানে টিকিট কাটতে এসে যেন যানজটের সৃষ্টি না হয়, কেউ যেন ইভটিজিংয়ে শিকার না হয় সেজন্য আমরা বিভিন্ন স্পটে প্রবেশ টিকিট বিক্রি করছি। কেউ যদি একের অধিক টিকিট কেনে আমাদের কী করার আছে।