শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পাঁচ মাস পেরিয়ে গেছে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট ক্ষমতাচ্যুতি ঘটে আওয়ামী লীগ সরকারের।
জনরোষে ক্ষমতা হারানোর কয়েকদিন পরেই ভারতীয় গণমাধ্যমে শেখ হাসিনার বরাতে একটি খবর প্রকাশ হয়। যেখানে হাসিনা অভিযোগ করেন, তাকে ক্ষমতাচ্যুত করার পেছনে যুক্তরাষ্ট্র তথা আমেরিকার হাত রয়েছে।
জনরোষে ক্ষমতা হারানোর কয়েকদিন পরেই ভারতীয় গণমাধ্যমে শেখ হাসিনার বরাতে একটি খবর প্রকাশ হয়। যেখানে হাসিনা অভিযোগ করেন, তাকে ক্ষমতাচ্যুত করার পেছনে যুক্তরাষ্ট্র তথা আমেরিকার হাত রয়েছে।
যদিও পরে তার ছেলে এবং উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় দাবি করেন, তার মা বাংলাদেশ ছেড়ে আসার পর এমন কোনো বক্তব্য-বিবৃতি দেননি।
বিদেশি শক্তির ‘ষড়যন্ত্র তত্ত্ব’ পতনের আগেও দিয়েছিলেন শেখ হাসিনা।
গণভবনে থাকাকালে একাধিক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেছিলেন, তাকে ক্ষমতাচ্যুত করার চক্রান্ত চলমান। এমনকি একটি বিশেষ দেশকে বাংলাদেশের ভূখণ্ডে (সেন্টমার্টিন) বিমানঘাঁটি নির্মাণের অনুমতি দিলে তিনি ‘কোনো সমস্যায়’ পড়বেন না বলে আশ্বাস পেয়েছিলেন বলেও দাবি করেন।
আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব থেকে তৃণমূলের নেতা-কর্মীদেরও অনেকের ধারণা, জুলাই বিপ্লবের পেছনে আমেরিকার ভূমিকা ছিল। ভারতীয় গণমাধ্যমেও এই বয়ানের পক্ষে অনেক প্রতিবেদন দেখা গেছে। তাদের খবরেও আকারে ইঙ্গিতে জো বাইডেন প্রশাসনকে দায়ী করা হয়েছে হাসিনার পতনের জন্য।
কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র বরাবরই এ ধরনের অভিযোগ নাকচ করে আসছে। আগস্টেই হোয়াইট হাউসের প্রেস সেক্রেটারি ক্যারিন জঁ পিয়েরকে এই নিয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি সাফ ভাষায় দাবি করেন, বাংলাদেশে সরকার বদলের সঙ্গে আমেরিকার কোনো সম্পৃক্ততা নেই।
এবার বিষয়টি নিয়ে খোলাখুলি কথা বলেছেন যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা উপদেষ্টা জ্যাক সুলিভান। ভারত সফর থেকে ফিরে গত ১০ জানুয়ারি সকালে হোয়াইট হাউসে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার সময় তিনি জানান, শেখ হাসিনা সরকারের পতন এবং অন্যান্য ঘটনাপ্রবাহে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো হাত ছিল না
সুলিভানের কাছে জানতে চাওয়া— বাইডেন প্রশাসনের অধীনে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক বিতর্কিত পরিস্থিতিতে শেষ হয়েছে কি না। শিখ নেতা গুরপতওয়ান্ত সিং পন্নুর হত্যার ষড়যন্ত্রের অভিযোগ, শিল্পপতি গৌতম আদানির বিরুদ্ধে অভিযোগ, বাংলাদেশে ক্ষমতা পরিবর্তনে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা সম্পর্কে ভারতে জল্পনা এবং ভারতকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করছে যুক্তরাষ্ট্রের ডিপ স্টেট—ক্ষমতাসীন বিজেপির এমন অভিযোগের প্রেক্ষাপটে প্রশ্নটি করা হয়। পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের ‘ডিপ স্টেটের নেতৃত্বদাতা’ হিসেবেও তার দিকে ইঙ্গিত করা হয়, এমন অবস্থান থেকে সুলিভানের কাছে উত্তর চাওয়া হয়।
আমেরিকার এ নিরাপত্তা উপদেষ্টা বলেন, আমি প্রথমেই বিনয়ের সঙ্গে এ ধারণা প্রত্যাখ্যান করব যে আমি ডিপ স্টেট পরিচালনা করি এবং একই সঙ্গে বিনয়ের সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করব যে বাংলাদেশে ঘটনার পেছনে যুক্তরাষ্ট্র ছিল। বিষয়টি সম্পূর্ণ হাস্যকর।
ভারত সফরে বাংলাদেশের ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে আলোচনা হয়েছে জানিয়ে সুলিভান বলেন, ভারতীয় শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে আমার কথোপকথনের ভিত্তিতে, আমি বিশ্বাস করি না যে তারা মনে করেন, আমরা এর পেছনে ছিলাম।
সুলিভানের এ বক্তব্যের বিষয়ে নয়াদিল্লি বা আওয়ামী লীগের কারও মন্তব্য পাওয়া যায়নি।
অবশ্য শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের নেতারা তাদের ক্ষমতাচ্যুতির পেছনে আমেরিকাকে সন্দেহ করলেও বিরোধী দলগুলো তা মনে করে না। তাদের অভিযোগ, বরং বছরের পর বছর জনগণকে ‘দিল্লি’ দেখিয়ে বিতর্কিত নির্বাচন করে ক্ষমতা দখল করে রেখেছিল তারা।
‘দিল্লি’ নির্ভরতা আওয়ামী লীগের নেতাদের বক্তব্যেই বিভিন্ন সময় উঠে এসেছিল। ২০১৮ সালের ডিসেম্বরের বিতর্কিত নির্বাচনের আগে খোদ শেখ হাসিনা সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, ‘আমরা ভারতকে যেটা দিয়েছি তারা তা সারা জীবন মনে রাখবে। ’
২০২৪ সালের জানুয়ারির ‘ডামি’ নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছিলেন, ‘তলে তলে আপস হয়ে গেছে। দিল্লি আছে, আমেরিকারও দিল্লিকে দরকার। দিল্লি আছে আমরা আছি। শত্রুতা কারও সঙ্গে হবে না সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব হবে। শেখ হাসিনা সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব করে ফেলেছেন। ’
২০২২ সালের আগস্টে চট্টগ্রামে হিন্দু সম্প্রদায়ের এক অনুষ্ঠানে তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশে শেখ হাসিনাকে টিকিয়ে রাখতে যা যা করা দরকার, ভারত যেন তা করে সেজন্য তিনি ভারতের কাছে অনুরোধ জানিয়েছেন। ’
কিন্তু শেষ পর্যন্ত ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে টিকতে পারেনি শেখ হাসিনার সরকার।
মূলত গত জুলাইয়ের শুরুর দিকে সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন শুরু হয়। তখন তা দমনে প্রথমে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগকে মাঠে নামানো হয়। এরপর শেখ হাসিনার সরকার আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে ব্যবহার করে মাত্রাতিরিক্ত বলপ্রয়োগ করে। এ কারণে ওই আন্দোলন রূপ নেয় সরকার পতনের আন্দোলনে। এক পর্যায়ে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান ঘটে।
সেই আন্দোলনে সরকারের হিসাব মতে, অনেক শিশু-কিশোরসহ আট শতাধিক মৃত্যু হয়েছে। যদিও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের স্বাস্থ্য বিষয়ক কেন্দ্রীয় উপ-কমিটির তথ্য মতে, আন্দোলনে শহীদের সংখ্যা দেড় হাজারের বেশি।
এছাড়া সরকারের হিসাবে, আহত হয়েছেন ২৩ হাজারের বেশি মানুষ। এদের মধ্যে ৪০০ জন চোখ হারিয়েছেন। দুই চোখ হারিয়েছেন ২০০ জন।